করোনা ও দুর্গাপুজো
Opinion
অ্যাননিমাস@iiserk (জনৈক আইসারীয়)
প্রতিবছর শারদোৎসবের সূচনাকাল আপামর বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। কিন্তু এইবছরে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ আমাদের কপালে ফেলেছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।প্রত্যেকেই বিগত সাতমাস ঘর-বন্দিদশায় কাটিয়ে অবশেষে চেয়ে আছে আগামী সপ্তাহে নিয়ম বদ্ধ জীবন থেকে সামান্য মুক্তির দিকে। তবে এর মাঝে ভাইরাস কিন্তু বিশ্রাম নিচ্ছে না। এই নতুন জীবনশৈলীর সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানো তুলনামুলকভাবে মুশকিল হলেও অসম্ভব নয়। কি কি পদ্ধতি অবলম্বনে আনন্দ উৎসবের মাঝেও অতিরিক্ত সংক্রমন রোধ করা সম্ভব তা এই পাঠ্যে সংকলিত করা হল।
Tweet
ভারতবর্ষে বাঙালির সবথেকে বড়ো উৎসব হল দুর্গাপুজো। শুধু পশ্চিমবঙ্গই না, ভারতবর্ষ এমনকি সমগ্র পৃথিবীর মানুষ প্রতিবছর অপেক্ষা করে থাকেন এই সময়টার জন্য। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব, সর্বস্তরের বাঙালির অন্তরাত্মা ও শিকড়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আজ কয়েক শতক জুড়ে।
কিন্তু বাকিবছরের থেকে এবছরের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। কারণ কোভিড ১৯। সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক জীবনযাপন বিগত পাঁচ মাসে ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে এই অতিমারীর প্রকোপে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিস্থিতিতে দুর্গাপুজো করা আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত। কারণ উৎসব মানেই সেখানে অজস্র মানুষের সমাগম, এবং দুর্গাপুজোর মতো উৎসব, যাতে শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই সমাগম ঘটে কয়েক কোটি মানুষের, তা বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে সামনের দিনে পশ্চিমবঙ্গের কোভিড সংক্রমণের হারে।
কেন এরকম? কারণ জনসমাগম আর করোনা ছড়ানোর সম্পর্ক। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিবছর উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করে, তাতে আর যাই হোক, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব।
একই জায়গায় অধিক ভীড় ব্যাপকভাবে বাড়াতে পারে কোভিড সংক্রমণের হার। অন্তত এমনটাই মনে করছেন গবেষকদের একদল। তাদের মতে1, কোনস্থানে জনঘনত্বের উপর কোভিড সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রিত হয়। কলকাতার একাধিক বিখ্যাত পূজামন্ডপের উপচে পড়া ভিড়, কয়েক কিলোমিটার লম্বা লাইন প্রতিমা দর্শনের জন্য, এগুলো সহজেই প্রমাণ করে, প্রতিটি প্যাণ্ডেলে জনঘনত্ব কতটা চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে পৌঁছয়, যা কোভিড সংক্রমণের হারকে মারাত্মকভাবে বর্ধিত করতে পারে।
শুধু তাই নয়, কলকাতায় পুজো উপলক্ষে ভিড় শুধু পুজোমন্ডপে নয়, এই শহরের প্রতিটি আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন যানবাহনে দেখা যায় মানুষের মাত্রারিক্ত উপস্থিতি । NDTVর রিপোর্ট অনুসারে, গতবছর পুজোর একদিনে ২৪ ঘন্টায় মেট্রো ব্যবহার করেছেন ৯.১১ লাখ মানুষ, যা কলকাতা মেট্রোর ইতিহাসে রেকর্ড।2 এবাদেও বাস, লোকাল ট্রেন, সব যাতায়াতের মাধ্যমেই একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। আশেপাশের জেলা, যেমন হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগণা, বীরভূম প্রভৃতি কলকাতায় ঠাকুরদর্শন করতে আসেন কয়েককোটি মানুষ।
সম্প্রতি বেরনো একটি গবেষণাপত্রে একদল গবেষক দেখিয়েছেন, কোভিড সংক্রমণের হার সেইসব শহরের মধ্যে অনেক বেশি, যাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। অর্থাৎ, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘনঘন বা একইসাথে অজস্র মানুষের যাতায়াত, প্রবলভাবে বৃদ্ধি ঘটাতে পারে সংক্রমণের।3 এরফলে দুর্গাপুজোয় কলকাতা নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে ঠাকুরদর্শনে লোকজনের কলকাতায় আগমণ ও পুনরায় ফিরে যাওয়া, পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলতে পারে।
এবং কেবল পশ্চিমবঙ্গই নয়, দুর্গাপুজো উপলক্ষে সারা বছরের শেষে ঘরে ফেরেন দেশবিদেশের বাঙালিরা। এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সূত্র অনুসারে, শুধুমাত্র ষষ্টীর দিনে কলকাতায় অবতরণ করেন প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। এবং পুজোর পাঁচ দিনে অ্যারাইভাল ও ডিপার্চার মিলিয়ে সংখ্যাটা আগেরবছর পৌঁছেছিল ৩.১ লাখে, যা ২০১৮য় ছিল ২.৫ লাখ।4 এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই, এইবছর করোনা আবহে এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার কাছাকাছিও উপস্থিতি কলকাতা সহ বাংলার মানুষের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
অতি-সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের গবেষকদের প্রকাশিত করোনা-সংক্রমণের একটি ছয় মাত্রিক গাণিতিক মডেলে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সেই অনুসারে মহাষষ্ঠীর দিন, পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমিতের সংখ্যা হতে পারে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ১৮৪।5
এখন এই অবস্থায় প্রশ্ন হল, তাহলে কি এবছর বাঙালির দুর্গাপুজো হবে?
আমরা জানি, এইবছরে বাতিল হয়েছে টোকিও অলিম্পিক, উইম্বলন্ডন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইফাতার পালিত হয়েছে অনেক মৃয়মাণভাবে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশে স্থগিত থেকেছে সেখানকার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ঢাকার বিখ্যাত মঙ্গল শোভাযাত্রা।6
কিন্তু দুর্গাপুজো?
এর আগে কুখ্যাত স্প্যানিশ ফ্লু, দুই বিশ্বজুদ্ধ, এমনকি ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যাও বাঙালির দুর্গাপুজো বন্ধ করতে পারেনি। এবং এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুসারে, পুজো এবছর হচ্ছে।
এখন পুজো যদি হয়ই, সেক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। বেশকিছু বিধিনিষেধ নিজেদের মতো করে তৈরি করেছে পুজো উদ্যোক্তা সমিতিগুলোও।
পুজো উদ্যোক্তাদের কথা অনুসারে, মন্ডপ জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য তারা মন্ডপচত্বরে মাস্ক ছাড়া দর্শনার্থীদের প্রবেশের অনুমতি দেবেন না। এছাড়া পুজো উদ্যোক্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও প্যান্ডেলে মাস্ক পরে থাকবেন।7 সংক্রমণ এড়াতে প্যান্ডেলে একইসময়ে উপস্থিত দর্শনার্থীদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যদিও, ভেতরে নির্দিষ্ট করলেও, ওই মন্ডপ ঘিরে বাইরে প্যান্ডেলের চারপাশে জনপ্লাবন অনিবার্য, এবং একইসাথে সামাজিক দূরত্ববিধির লঙ্ঘনের সম্ভাবনা প্রবল।
অন্যদিকে প্রশাসন এই পরিস্থিতিতে পুজো কিভাবে হবে, সেই নিয়ে একাধিক বৈঠকের পরে প্রকাশ করেছে তাদের গাইডলাইন। এই গাইডলাইন মেনেই একমাত্র পুজো করা ও প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন বাঙালি জনসাধারণ। এই গাইডলাইন অনুসারে –
WHO এর গাইডলাইন অনুসারে, এবারের অধিকাংশ মন্ডপ খোলা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনদিক খোলা প্যান্ডেল, যাতে দূর থেকে বা গাড়ির ভেতর থেকেই তা দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন প্যান্ডেলে আবার অনেকে চেষ্টা করছেন, মন্ডপের সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ রাখার, যাতে গাড়ি থেকে না নেমে ভেতর থেকেই প্রতিমা দর্শন করে বেরিয়ে যাওয়া যায়। এতে সংক্রমণের সংখ্যা হয়তো কমানো যাবে বলে তাদের ধারণা। অনেকে চেষ্টা করছেন প্যান্ডেলের ঢোকার মুখে স্যানিটাইজিং টানেলের মধ্যে দিয়ে দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়ার, ভোগ ডিস্ট্রিবিউশন টিফিন কেরিয়ারের মাধ্যমে করা ও সিঁদুর খেলার স্থান ট্যাঙ্কার নিয়ে এসে স্যানিটাইজ করা।9
কিন্তু সবশেষে এই পুজো কতটা সুস্থভাবে করা যাবে, কোভিড সংক্রমণের হার বৃদ্ধিকে কতটা আটকানো যাবে, তা নির্ভর করছে আপামর বাঙালি জনসাধারণের হাতে। পূজো দেখতে বেরিয়ে নিভৃতবাসের সামাজিক দূরত্ববিধি আদৌ কতটা পালন করতে পারলেন তারা, মাস্ক, স্যানিটাইজেশন সহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি কতটা মেনে চললেন, তা অনেকাংশে স্থির করবে পুজোপরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে করোনা পরিস্থিতি কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে।
তাই আপাতত, এই অতিমারীর কালে, সেই আশাতেই এই প্রবন্ধ সমাপ্ত করা হল।
Editor's Note: (Summary in English)
The COVID19 pandemic has been wreaking havoc throughout the globe for the past six months. To curtail the rate at which this human transmitted disease is spreading, any unnecessary gatherings have been prohibited. India is currently heading towards becoming the highest infected nation in the world. But, the festive season is knocking on the door, and it entails social gatherings…
The rise or fall of the COVID19 infection rate in Bengal is now heavily dependent on the proceedings of Durga Pujo and people’s participation in it. In this article, the author hints towards the risks especially pertaining to this year and outlines some measures which should be taken to avoid any post-festive calamities. This article is a must read during this festive season, amidst the pandemic.
তথ্যসূত্রঃ
‘অজ্ঞাতনামা’ এই ব্যক্তি সমগ্র সাহিত্যের ইতিহাসে অগুনতি গদ্য ও পদ্যের মাধ্যমে বিরল সহিত্যরসের অভূতপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করেছেন, ও ক্রমাগত করে চলেছেন। কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়। পৃথিবীর সকল ভাষাতেই তাঁর ঐতিহ্যবাহী সৃষ্টির উদাহরণ অফুরন্ত। অত্যন্ত আহ্লাদের বিষয় এই যে, তিনি ইদানিং সমাজকল্যানে বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ (vikas) ঘটানোর মহৎ উদ্যেশ্যে আমাদের Cogito137 শীর্ষক পত্রিকায় লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
signup with your email to get the latest articles instantly